বাংলার গান


  আমি লিখছি না কোনো কবিতা,
             কোনো লায়লা কিংবা, 
     শকুন্তলার আর্তনাদ। 
              না কোনো মহাভারত। 

আমি লিখছি তোমার আমার গান। 
লিখছি, সাঁওতালি ঝুমুর আর
      একতারার প্রতিদান। 
বিনয়ী-সিধে মেষপালকের পায়চারি, 
আমার বাংলার আঙিনায়, 
    তারই দু-চার কথার অভিধান। 

আমি লিখছি না কোনো সমাবেশ
       কোনো মিছিল, খুনোখুনি। 
কিংবা কোনো ঘুমিয়ে থাকা, 
           জাতির বাউল। 
না কোনো মহাজন, 
       না কোনো শাসকের কথা। 

আমি লিখছি বহুতলের ধারে ঝুপড়ির কথা। 
 রসিক বাঙালির ছোঁয়াচে আড্ডার, 
    আদুরে টেবিলের ঘনঘটা।  
লিখছি, পূজোর ঢাকের আনন্দ, 
   আর ঈদের চাঁদে উপবাসের সমাপ্তি। 
লিখছি ,আত্মা আর সাহিত্যর মিলন, 
     সাহস আর নম্রতার স্পন্দন। 

লিখছি তোমার আমার গান। 
     লিখছি বাংলার গান,  বাঙালির গান।। 

শেষ ট্রেন

'সেদিন সন্ধ্যার পরে ট্রেনের অপেক্ষায়  বেশ খানিকটা সময় পার করে ফেলেছি আমি। লোকের ভীড়টা আস্তে আস্তে কমে গেছে অনেকটাই। একটা বেকার যুবকের যে চিন্তা গুলো ঘুরপাক খায়,আমি সেই একই চিন্তার মোহে বসেছিলাম। শীতের শেষে একদম শান্ত ,পরিস্কার আকাশে তারাদের বৈঠক আর চাঁদের আনমনা ভাবটা সেদিনের আকাশটাকে  অতিষ্ট  করে তুলেছে।'
     কিছু মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার সন্ধিটাও ইতি মধ্যে টের পেয়ে 
গেছি। 
'স্টেশন এর আলোয় শুধু একা আমারই যেন প্রাণ রয়েছে ,বাকি প্রাণহীন ফাঁকা অন্ধকারে প্রানবন্ত কিছু জোনাকির আপোসহীন আনন্দ ,দূরে ট্রেনের  হর্নের চলমান বিচলিত আওয়াজে প্রাণের জানান দিচ্ছে। 
এই নিস্তব্ধতা বর্ণনা করছে হাজারো মন ভাঙ্গার গল্প। 
             'মনে মনে এই ই ভাবছিলাম' কারণ একাকিত্ব আর নিস্তব্ধতা নিঃস্বার্থ ভাবনার সুযোগ করে দেয়, আর সেদিন এই সুযোগটা আমি হারাতে একদম রাজি ছিলাম না। 
     'ক্লান্ত শরীর টা শৈশবের  কিছু মুহুর্তকে চোখের সামনে হঠাৎ পরিবেশন করল। সহজ -রঙিন পৃথিবী ছিল তখন । আনন্দ আর খেলাধুলার আঙিনায় কখন যে দায়িত্ব, কর্তব্য আর বার বার আঘাত পাওয়ার পাথর গুলো এসে পরেছে ,বয়সের সাথে সাথে ঠিক বুঝতে পারা যায়নি। '
         চারিদিকে তখন দু-চারটে লোকের সংখ্যা বেড়েছে শেষ ট্রেনের প্রতিক্ষায়। 
          'একটা ঠান্ডা বাতাস আমায় সব ভাবনা-চিন্তা আর আত্মগ্লানি থেকে ছন্দে ফিরিয়ে এনেছে ততক্ষণে। 
           যথারীতি ট্রেন এলে, ফাঁকা জানালার ধারে বসে বাইরের হঠাৎ বাড়ি ফেরার ব্যস্ততাটা চোখে পড়ল। 
আমি ওদিকেই চেয়েছিলাম। 
            'আবছা আলোয় খুবই পরিচিত একটা চেহারা' জোৎস্নার মতো উঁকি দিচ্ছে স্টেশন চত্বরে। আমার হৃদয়ের কবরে তখন মুখশ্রীটা দেখার  প্রবল ইচ্ছা দুমড়ে-মুচড়ে হাহাকারের রূপ নিয়েছে। 
                      কিন্তু সেদিন সময়ের বুঝি একটু বেশিই তাড়া ছিল  , তাই সে শুধু জানালার বাইরের অন্ধকার থেকে একটা বাতাস আমার দিকে ছুঁড়ে পরিহাস করে নিমেষেই মিলিয়ে গেল। 

      

বিস্বাদ

আজ বৃষ্টি বেলার অন্তিম সুরে, 
চিন্তিত আমি একা। 
হাজার তারার উজান বই এ, 
আজই বিস্বাদ প্রতিবেলা। 
ক্রোধের স্বরে চোখ ভিজে যায়, 
ভেসে যায় ভালোবাসা। 
এ কোন সুভাসে  সজ্জিত আমি? 
আসলে কোনো কুন্ঠিত পৃথিবীর ভাষা। 

তোমায়  ঘিরে  কত  আশা, 
কত  শত্রুর  সাথে  দেখা। 
একটু থেমে লিখে নিলে তবে, 
শেষ  হয়ে  যেত  পাতা। 
ঋতুর পর ঋতু, বছর পার হয়ে যায়, 
শেষ হয়ে যায় শিখা। 
নেভানো আলোর পাশে দাঁড়িয়ে, 
শুধু নিভে যায় আমি একা। 

আজ এই বৃষ্টি বেলার অন্তিম সুরে, 
চিন্তিত আমি একা। 
হাজার তারার উজান বই-এ, 
আজ বিস্বাদ প্রতি বেলা।। 

নিবেদন

'সকালের বাতাসে, সূর্যের আলতো হাতের স্পর্শ পৃথিবীর নরম ঘাসের উপর পড়লে  পৃথিবী যে রকম মত্ত হয়ে ওঠে, যে রকম শুদ্ধ বাতাস হাজার হাজার মাইল বয়ে গিয়ে মেস্কের শুদ্ধতা আর জীবন্ত প্রাণের স্পন্দন ছড়িয়ে দেয়, তার থেকেও বেশি সুগন্ধি আর শুদ্ধতা ছিল তোমার নিশ্বাসের মধ্যে। '
কি আশ্চর্য হাতে গড়া ছিল সেই গলার আওয়াজ, আমার মত হাজার হাজার আবেগী হৃদয়কে শিহরিত করে চলে যায় তোমার প্রতিটি  শব্দের আঘাত। শরৎ এর কোনো সন্ধ্যায় চন্দ্রিমার আধোঁ উঁকি মারার দৃশ্য যেমন লাগে, তার থেকেও বেশি শানিত ঔজ্জ্বল্যের দৃপ্ত ছড়ায় তোমার চেহারা। আমার মত লক্ষ লক্ষ সাধারণের মনকে ক্রয় করে নিয়েছে তোমার সুরার নেশা।  দুটি পাহাড়ের মাঝে অস্তাচলগামী সূর্যের আলোর থেকেও বেশি গভীর, স্নিগ্ধ, শান্ত লাগে তোমার চাহনি । 
সেই চাহনি টা এমনই যে আমার হৃদয়ের  শিরা-উপশিরাকে আলোড়িত করে, তারা হুংকার ছেড়ে বিদ্রোহ করে। '






'বির্সজন'

        'আমি আমিত্বের স্বার্থেই যত বির্সজন দিই, 
         স্বার্থপরের কাতারে রেখেছে আমাকে!! '

        'সিগারেটের ধোঁয়ায় যুবকের আশিয়ানা, 
     আর নিশ্চিন্ত আয়াসের রঙিন মধ্যবিত্তর স্বপ্ন, 
    কর্তব্যশীলতার জাল বুনতে বুনতে নিরিহ মাছির
       কোলাহলে তুমি আবদ্ধ হয়ে যাবেই যাবে
                                          এই পৃথিবীতে। '
'বুকভরে বাচাঁর আকাঙ্খা শীতল মহাশূন্যের মতো।
         যেটাকে দূর থেকে দেখে দারুণ লাগে, 
          কিন্তু কাছের জন্য স্নিগ্ধ, শান্ত, পবিত্র
          ব্যক্তিত্বের আবহ লাগে, যা তোমার
           ড্রিম লাইটের আলোর  মতই ক্ষীণ । '

      ' তবুও চেনা যায়, তুমি অযান্ত্রিক নিষ্ঠুর নও। '
   মানুষের ভাবাবেগের দ্বারে দাঁড়িয়ে, তুমি কখনই
             যান্ত্রিক হয়ে যাবে না, আমি জানি। 
          কিন্তু কি জান, মানুষের ভীড়ে দাঁড়িয়ে, 
     হঠাৎ হোঁচট খেয়ে রাস্তায় পড়ে যাওয়া আমায়, 
           ওই কালো পিচের বিছানাটা থেকে, 
        সুভ সকালের শুভেচ্ছা জানিয়ে আজও
                      কেউ উঠাইনি। 
   আর কেউ উঠাইনি বলেই, তুমি আমায় আজ
         স্বার্থপরের দলে দেখার ক্ষমতা রাখো। 


'হারানো চিরকুট'

'আমি আস্ত একটা প্রদীপ', "সুধীর"। কখনো নিষিদ্ধ নিকোটিনের পাশে ,সেই ছেলেটির সাথে থেকেছি। ওঁর টেবিলের কোনায় বইয়ের ভিড়ে আমাকে কোনোদিন হারাতে হয়নি। ওঁর নীল ফ্রেমের চশমাটার পেছনে মায়াবী চোখদুটি প্রকাশ করতো, লুকিয়ে রাখা কিছু ইচ্ছা, আনন্দ আর রোজকার কোলাহলের জীবনে কিছুটা নিস্তব্ধতা। 
  'সৎ ছিল, চেনা-অচেনা আলোর থেকেও খুব নিপুণভাবেই আমায় আলাদা করে নিত খুব সহজেই। '
              আজ অন্য কারোর টেবিলে আছি কিন্তু আমার উজ্জ্বলতার কোনো হেরফের হয়নি, তবুও সেই চোখদুটো আর পাইনি। 
     ' মায়া এক অদ্ভুত বিষন্নতা ,সুধীর'। খুবই ছোয়াঁচে, সব কিছুই এর মধ্যে পরতে পারে। হয়ত তুমি, তোমার স্মৃতি কিংবা তোমার সঙ্গে চা চর্চার এই মুহূর্ত গুলো । যদিও এই চা পানে আমার অংশগ্রহণ খুবই কম। 
      'পৃথিবীটা রঙিন, তাই না? ' কিন্তু চারিদিকের এই রঙের মাঝে আছে বৈকি কিছু বেসুরো বাঁশির অবহেলিত ধুন। 
    'রোজকার ভাঙা -গড়ার মাঝে, আমি একা জানো।। '
আমি সঙ্গ দিতে জানি কিন্তু আজকের দিনে সঙ্গী খুব একটা পাওয়া যায় না। যাই হোক, তোমার মতো দু-চারটে সাহচর্য  যে পাই না, তা নই। 
              'খুব কাছ থেকে দেখেছি তোমায়। সাধারণ মধ্যবিত্ত মনন হলেও, বেশ আবেগি হৃদয়ের লোক তুমি, সুধীর। '
     'সকালের দার্জিলিং চা এর সাথে আনন্দবাজার থেকে শুরু করে দুপুরে আরাম কেদারায় রবীন্দ্রসঙ্গীত সবই তোমার চেহারার আওতায় আসে। এটা তোমার জানা আছে নিশ্চয়। '
      অতি সফল একজন বাঙালি পুরুষের আভিজাত্য তোমার নেই। কিন্তু অতিথির আতিথেয়তায় তোমার বিকল্প পাওয়া সহজ কাজ নয়। 
        ' আমি নিতান্তই একজন স্থবির না হলে, তোমার অতিথি হয়ে অবশ্যই এসে পড়তাম। '
          'আমার চার-চারটে পাতায় তোমার চোখ যায়নি, না হলে খুবই সহজেই তুমি তোমায় দেখতে পেতে। 
কিছু না খোলা চিরকুট ছিল, ওই চারটে পাতায়। সবটা মিল না থাকলেও তোমায় কিছুটা খুঁজে পেয়ে যেতে, এতে সন্দেহ নেই। '
     ' দুর্গম এই সামাজিক কোপে আমি খন্ডিত'। কিন্তু যখন তোমার টেবিলের কোনায় থাকি তখন অবশ্যই এটা আশা রাখি যে, তোমার নজরে কিছু সময়ের "সঞ্চিতা" হয়ে থাকতে পারবো। তারপর না হয় সেই সারি সারি অসহায় এর মাঝে আমি জ্বলজ্বল করে , কিছুক্ষণ পরে নিভে যাব। আবারও হয়ত আর এক পাঠকের টেবিলের কোনায় জায়গা করে নেব।'  
                   'কলমের খেলায় রচিত, কিছু রঙের মিশ্রণ যখন ফাঁকা -মুমুর্ষ প্রাণের ছোঁয়ায় আসে, সত্যিই আমি কাগজের ভাঁজে থেকে সেই প্রাণে কিছু আলপনা এঁকে দিই। সেই আলপনার শক্তি, তোমায় নতুন প্রাণ হয়ত দেয় না। কিন্তু তোমার ওই ফাঁকা প্রাণে কিছু রঙিন হাওয়ার আবেশ প্রফুল্ল আমেজে, প্রাণের পালে আলতো মিষ্টি আঘাত অবশ্যই পরিবেশন করে।'

"গোধূলি"

একটা বিস্তীর্ণ আকাশ ,কোথায় যেন দূর দিগন্তের গাঢ় নিকশ কালো গাছগাছালির আড়ালে মিলিত হওয়ার অভিপ্রায়ে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। সুন্দর এই আকাশ,  নীল কোনো আত্মভোলা ফুলের মতই বিদ্যমান। আর আমি সেই ফুলের এক অলি, যে সেই ফুলের অতল তলের মধ্যে থাকা গাঢ় অমৃত সুধা পান করছি আজকের এই বিকালে। সবুজে ঢাকা মাঠের মধ্যে কোনো কোনো জমি দ্বীপের মত জেগে আছে, যেখানে এখনও ধান বোনা হয়নি। এরই মাঝে পুকুরের গাছগুলো তাকে বেষ্টন করে আছে দাড়োয়ানের মতো। যেন মানা আছে তাদের সেই র্দূভেদ্য অদৃশ্য প্রাচীর ভেদ করে একটু জলের আস্বাদ পেতে। 
               শিল্পীর কালির দোয়াত গড়িয়ে পরে নীল গগনে এক চিত্রপট তৈরি করেছে, যা আত্মগ্ৰাহ্য হয়েছে আমার। "কোন সে তুলি? " যা দিয়ে শিল্পীর হাতে গড়া এই পটে বিচ্ছিন্ন কয়েকটা মেঘ ভাগাভাগি করে বর্ষার বার্তা নিয়ে আসে। পশ্চিমদিকের অস্তমিত সূর্যের আলো যখন দূর পূর্বদিকে ছড়িয়ে পড়ে, দেখে মনে হয় সেই আলো মেখে মেঘগুলো প্রান ফিরে পেয়েছে। 
               'কি নিগূঢ় প্রেম তোমার প্রকৃতি , কি নেশা ছড়িয়ে দাও তুমি। 'সব কিছু ছেড়ে ফিরে যেতে চাই তোমার কাছে। তোমার হাতের একটু স্পর্শ নিতে। তোমার নিশ্বাসের আভাস পেতে। 
              শত দিন যাক, শত বছর যাক থেকো যেন এভাবেই। হয়ত বা কখনো ফিরে যাবো তোমার ভালোবাসার একটুকু গন্ধ নিতে। এভাবেই আমার বিষন্ন ক্লান্ত মনকে আনন্দ দিতে থেকো। যতদিন আমি আছি আর তুমি আছো। প্রকৃতি!!